নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

নিউমোনিয়া হলো একটি গুরুতর ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ। নিউমোনিয়া দ্বারা কেউ আক্রান্ত হলে ফুসফুসের এয়ার স্যাকগুলো ফুলে ওঠে এবং তরল বা পুঁজ দিয়ে পূর্ণ হয়ে যায়। এটি সাধারণত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, বা ফাঙ্গাল সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। যেকোনো বয়সের মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
তবে শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি এবং দুর্বল ইমিউন সিস্টেমের লোকের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। চলুন জেনে নেই নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে।

নিউমোনিয়া কি?

নিউমোনিয়া হলো স্ট্রেপটোকক্কাস এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট এক ধরনের ফুসফুস জনিত রোগ। এই রোগের ফলে শ্বাসকষ্ট, কফ সহ বা কফ ছাড়া কাশি, জ্বর, ক্লান্তি, অস্থিরতা এমনকি বুকে ব্যাথা সৃষ্টি হতে পারে। 

নিউমোনিয়ার কারণ

নিউমোনিয়ার লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানার আগে এর কারণ সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। নিউমোনিয়া প্রধানত তিনটি প্রধান সংক্রমণজনিত কারণে হয়। এগুলো হলো:-


ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ


সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণে। স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া (Streptococcus pneumoniae) এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা (Haemophilus influenzae) এর মত ব্যাকটেরিয়া সাধারণত নিউমোনিয়া সৃষ্টি করে।


ভাইরাল সংক্রমণ 


ভাইরাল নিউমোনিয়া সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস (RSV), এবং করোনা ভাইরাস দ্বারা হয়। এই ভাইরাস সংক্রমণটি প্রাথমিকভাবে ফ্লু বা সর্দি-কাশির মতো শুরু হয় এবং পরে নিউমোনিয়া সৃষ্টি করে।


ফাঙ্গাল সংক্রমণ


কিছু ফাঙ্গাল সংক্রমণ, যেমন হিস্টোপ্লাজমোসিস (Histoplasmosis) এবং ককসিডিওমাইকোসিস (Coccidioidomycosis), নিউমোনিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ফাঙ্গাল নিউমোনিয়া সাধারণত দুর্বল ইমিউন সিস্টেমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়।

নিউমোনিয়ার লক্ষণসমূহ

নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো সংক্রমণের ধরণ এবং রোগীর বয়স অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।


সাধারণ লক্ষণসমূহ


  • উচ্চ জ্বর ও কাপুনি


  • তীব্র শ্বাসকষ্ট এবং দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস


  • কাশি, বিশেষ করে ফ্লুইড বা রক্তমিশ্রিত কাশি


  • বুকে ব্যথা


  • অস্বাভাবিক ক্লান্তি এবং শারীরিক দুর্বলতা


  • মাথাব্যথা এবং মাশকুলার ব্যথা


  • বমি বা ডায়রিয়া


  • অস্থিরতা 


ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার লক্ষণ


  • হঠাৎ করে শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অত:পর তীব্র জ্বর।


  • তীব্র কাশি: ঘন কফ সহ কাশি, কখনও কখনও রক্তমিশ্রিত কাশি।


  • শ্বাস নেওয়ার সময় বা কাশি দেওয়ার সময় বুকে ব্যথা করে।


  • ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায় ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস হয়।


  •  শারীরিক দুর্বলতা এবং কর্মক্ষমতা হ্রাস



ভাইরাল নিউমোনিয়ার লক্ষণ


  • ভাইরাল নিউমোনিয়া সাধারণত মৃদু জ্বর সৃষ্টি করে।


  • শুষ্ক কাশি বা সাধারণত কফ ছাড়াই কাশি হয়।


  • শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা অনুভূত হয়।


  • দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি।


  • সর্দি এবং গলা ব্যথা



ছোট শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়ার লক্ষণ


  • দ্রুত বা শ্বাস বন্ধ হয়ে আসা।


  • খাবারের প্রতি অরুচি


  • শ্বাস নিতে কষ্ট হয় এজন্য খাবার খাওয়া এমনকি পান করায় সমস্যা হয়।


  • সাইনোসিস অর্থাৎ ঠোঁট বা আঙ্গুলের নখ নীল হয়ে যাওয়া।


  • শিশু নিঃসঙ্গ হয়ে গেলে অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে।


  • বমি এবং ডায়রিয়া হতে পারে।


বয়স্কদের মধ্যে নিউমোনিয়ার লক্ষণ


  • গোলযোগ এবং বিভ্রান্তি


  • মাঝে মাঝে স্বাভাবিকের চেয়ে কম তাপমাত্রার জ্বর।


  • খুব সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়া।


  • জীবনীশক্তি হ্রাস


  • শ্বাসকষ্ট

নিউমোনিয়ার প্রতিকার

নিউমোনিয়ার প্রতিকারগুলো হলো:- 


এন্টিবায়োটিক: ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার জন্য এন্টিবায়োটিক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। 


এন্টিভাইরাল ওষুধ

ভাইরাল নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে এন্টিভাইরাল ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এ ধরণের সংক্রমণে সাধারণত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা বেশি কার্যকর।


ফাঙ্গাল ওষুধ

ফাঙ্গাল সংক্রমণের ক্ষেত্রে বিশেষ ফাঙ্গাল ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।


ব্যথানাশক ওষুধ

বুকে ব্যথা এবং জ্বর কমানোর জন্য ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহৃত হয়।


এছাড়াও পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং বিশ্রাম নেওয়া নিউমোনিয়া প্রতিকারে সহায়ক।

নিউমোনিয়ার কিছু ঘরোয়া প্রতিকার 

চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া প্রতিকার এবং জীবনযাপনের পরিবর্তন নিউমোনিয়া থেকে দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করে।


বিশ্রাম 

পর্যাপ্ত বিশ্রাম শরীরের ক্লান্তি দূর করে যা নিউমোনিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে। 


পরিমিত পরিমানে পানি পান

পানি পান করলে মিউকাস শিথিল হয় এবং শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে।


স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ

স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম বুস্ট করতে সাহায্য করে ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।


ধূমপান বন্ধ করা

ধূমপান ফুসফুসের ক্ষতি সাধন করে। তাই ধূমপায়ী ব্যক্তির নিউমোনিয়া থাকলে তা আরও বেড়ে যায়৷ তাই ধূমপান পরিহার করতে হবে। 


হিউমিডিফায়ার ব্যবহার

এটি বায়ুতে আর্দ্রতা যোগ করে ফলে শ্বাস প্রশ্বাস সহজ হয়। 


মাথা উঁচু করে ঘুমানো

মাথা উঁচু করে ঘুমালে শ্বাস নিতে সুবিধা হয় এবং রাতে কাশি কমাতে সাহায্য করে।

বড়দের নিউমোনিয়া হলে করনীয় 

বয়স্কদের নিউমোনিয়া হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক চিকিৎসা নির্ধারণ করবেন। সাধারণত, নিম্নলিখিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়:


চেস্ট এক্স-রে

চেস্ট এক্স-রে ফুসফুসের সংক্রমণের পরিমাণ এবং অবস্থান নির্ধারণ করে। 


CBC Test

রক্ত পরীক্ষার CBC Test মাধ্যমে সংক্রমণের প্রকৃতি এবং জটিলতা নির্ধারণ করা যায়। 


স্পুটুম পরীক্ষা

কফ পরীক্ষা করে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সনাক্ত করতে হবে। 


এছাড়াও 


  • ধরন অনুযায়ী ওষুধ সেবন

  • বিশ্রাম 

  • পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ 

  • ফিজিওথেরাপি ও ব্রিদিং এক্সারসাইজ

  • ধূমপান পরিহারসহ ইত্যাদি বিষয় মেনে চলতে হবে। 

বাচ্চাদের নিউমোনিয়া হলে করনীয় 

বাচ্চাদের নিউমোনিয়া হলে প্রথমেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সাধারণত চেস্ট এবং ব্লাড টেস্ট করতে বলে। তাই CBC Test করানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 


বাচ্চার যে ধরনের সংক্রমণ রয়েছে তা নির্ধারণ করে ওষুধ সেবন করান। বাচ্চার ব্রিদিং এক্সারসাইজ এবং সুষম খাবার নিশ্চিত করুন। এছাড়াও বাচ্চাকে গরম পানির বাষ্প, গরম পানিতে গোসল এবং হালকা গরম পানি দিয়ে গার্গল করান। 

কখন ডাক্তার দেখানো উচিৎ 


নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তার দেখানো উচিৎ। এখানে কিছু লক্ষণ উল্লেখ করা হলো যা দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।


উচ্চ জ্বর

জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বা তার উপরে থাকলে কিংবা শীতে কাপুনি হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। 


শ্বাসকষ্ট

শ্বাস নিতে বা শ্বাস ছাড়তে সমস্যা হলে ডাক্তার দেখানো উচিৎ। 


বুকে ব্যথা


বুকে ব্যাথা হওয়া ভালো লক্ষণ না। শ্বাস নিতে বা কাশি করার সময় বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলে ডাক্তার দেখানো উচিৎ। 


কাশি

গাঢ় বা রক্তমিশ্রিত কফসহ কাশি হলে দেড়ি করা উচিৎ নয়।


ক্লান্তি এবং দুর্বলতা

প্রাথমিক অবস্থায় অস্বাভাবিক মাত্রায় ক্লান্তি এবং শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করলে ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক খাবার গ্রহণ করতে হবে। 


বমি বা ডায়রিয়া

অতিরিক্ত বমি হওয়া এবং খাবারের প্রতি অরুচি কিংবা বমির সাথে ডায়রিয়া হলে ডাক্তার দেখানো উচিৎ। 


নীলাভ ত্বক বা ঠোঁট


সায়ানোসিস বা ফুসফুসে অক্সিজেনের অভাবে ত্বক বা ঠোঁট নীল হয়ে যেতে পারে। এ সময় দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। 


চেতনা লোপ পাওয়া

বয়স্কদের মধ্যে অনেক সময় মানসিক ভ্রান্তি এবং সমন্বয়হীনতা দেখা দিতে পারে। 


শিশুদের বিশেষ লক্ষণশিশুদের খাবারের প্রতি অরুচি থাকা, শ্বাস নেওয়ার সময় কষ্ট এবং বুকের ভেতরে শো-শো শব্দ হতে পারে।

উপসংহার

নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে ডাক্তার দেখানো উচিৎ। দ্রুত চিকিৎসা এবং প্রতিকারের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

লার্নিং পয়েন্ট ২৪ নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url